হেলাল শেখঃ
ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়া, গাজীপুর এলাকায় সাভার তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে লক্ষাধিক, এই সংযোগ দিয়ে দালালদের পকেটে কোটি কোটি টাকা। তিতাস কোম্পানির কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তার অবহেলা ও অনিয়ম দুর্নীতির কারণে সরকারি সম্পদ গ্যাস হরিলুট হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেশিরভাগ বাসা বাড়িতে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি, এই গ্যাস লাইনে নিম্মাননের পাইপ দেওয়ায় অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় শিশু থেকে শুরু করে কোনো মানুষ নিরাপদ নয়, মনে হয় এ যেন বোমা। জানা গেছে, কিছুদিন আগেও আশুলিয়ার কাঠগড়ায় তিতাস গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে হাজী আগবরের একতলা ভবন ধসে ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মাগুড়ার নাজমুল হকের ছেলে অবুঝ শিশু তাছিম (২), নিহত হয়। এ সময়ে নারী ও শিশুসহ আরও ৪ জন আহতের ঘটনা ঘটে। তার আগে ভাদাইলসহ আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে অনেক মানুষ আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
৭ অক্টোবর ২০১৯ইং সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার ইয়ারপুর এলাকার মোঃ সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ), হানিফ,
মকবুল, মোঃ আব্দুল জলিলসহ ১৬-১৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিতাস গ্যাসের লাইন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক এক মালিকের কাছ থেকে ৫০-৮০ হাজার টাকা নিয়ে প্রথম সংযোগ দেয় এরপর দালালদের ইচ্ছায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর প্রতি বাড়ি থেকে প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে থাকে দালালরা। পুরো
এলাকা থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা কালেকশন করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান। এই চক্রের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায়
একাধিক মামলা করা হলেও গ্রেফতারের নামে কিছু অসাধু পুলিশ অফিসার আসামী আটক করে গাড়িতে ৩-৪ ঘন্টা রেখে
টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আশুলিয়ার কাঠগড়া একই স্থানে অবৈধভাবে ৭-৮বার গ্যাস সংযোগ দেয়ার
পর তা বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি নাটকীয়, এ যেন চোর পুলিশের খেলা বলে অনেকেরই অভিমত। জানা গেছে, যেকোনো এলাকায়
দুর্ঘটনা ঘটলে ওই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক (দিপু) তিনি
সাংবাদিকদের জানান,অপরাধী সে যেই হোক না কেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার নয়ারহাট, পল্লী বিদ্যুৎ,বাইপাইল, বগাবাড়ি, ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া,
ভাদাইল, পাবনারটেক, ইউসুফ মার্কেট, নরসিংহপুর, ঘোষবাগ, জিরাবো, কাঠগড়া, মানিকগঞ্জ পাড়া, মীর বাড়ি কাঠগড়াসহ
বিভিন্ন এলাকায় বাসা বাড়িতে অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি, এ যেন দেখার কেউ নেই। এসব অবৈধ সংযোগ পেতে দালাল
চক্রকে লাখ লাখ টাকা দিতে হয়েছে বলে গ্রাহকরা জানান। তারা বলেন, মাঝে মধ্যে তিতাস কোম্পানির কর্মকর্তারা অভিযান
চালিয়ে কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও আবার নিজেরা নি¤œমানের পাইপ দিয়ে সংযোগ চালু করেন বেশিরভাগ বাড়ির
মালিক। অনেকেই বলেন, এই সংযোগের অর্থ অনেকেই ভাগ পেয়ে থাকেন, এর কারণে এলাকাবাসী ওই চক্রের দালালদের বিরুদ্ধে
কেউ কিছু বলতে পারেননা। অনেকেই বিভিন্ন উপর মহলের পরিচয় দিয়ে তিতাস গ্যাসের এসব সংযোগ দিচ্ছেন। অনিয়ম
দুর্নীতি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, এমনই অভিযোগ উঠেছে গ্যাস ব্যবহাকারী গ্রাহক মহলে।
বিশেষ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রায় ২২টি খাতে দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে বিদ্যুৎ
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শিল্পাঞ্চলের যেখানে-সেখানে
তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করায় সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সচিবালয়ে বিদ্যুৎ,
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধানী
এবং পর্যবেক্ষণমূলক এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন দুদকের কমিশনার ড. মোজ্জামেল হক খান। “প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দুদকের এই কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, দুদকের এই প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে”। দুদক কমিশনার বলেন, ২০১৭ সাল থেকে দুর্নীতির জনশ্রæতি রয়েছে এমন ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে কমিশন। এসব প্রতিষ্ঠানের জনসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা ও সীমাবদ্ধতা, আইনি জটিলতা, সেবা গ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করে তা বন্ধের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৫টি প্রতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি টিমের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কমিশনার আরও বলেন, এসব টিম অনুসন্ধান চালিয়ে দুর্নীতির উৎস দেখতে সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে। তিতাস গ্যাস সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমটি তাদের অনুসনন্ধানে তিতাসের অবসরপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা, বর্তমান কর্মকর্তা এবং এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে, পরে তথ্য সংগ্রহ করেন,
সেটা পর্যালোচনাও করেন। এ ছাড়া তিতাসের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের
প্রতিবেদনসহ ভুক্তভোগী সেবা গ্রহীতাদের বক্তব্য ও পর্যালোচনা করেন টিম। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন,
নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদনও পর্যালোচনার আওতায় আনে তারা। সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমাদের এই টিম
তিতাসের দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র দেখতে হবে। এবং তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করেন।
মোজ্জামেল হক বলেন, তিতাসের এই প্রতিবেদনে ২২টি সম্ভাব্য দুর্নীতির উৎস প্রমান করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-অবৈধ
সংযোগ, নতুন সংযোগ অনীহা এবং অবৈধ সংযোগ বৈধ না করা, অবৈধ লাইন পুনঃসংযোগ, অবৈধ সংযোগ বন্ধে
আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়া, অদৃশ্য হস্তক্ষেপে অবৈধ সংযোগ দেয়া, গ্যাস সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা,
বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং, অনুমোদনের অতিরিক্ত
বয়লার ও জেনারেটরে গ্যাস সংযোগ, মিটার বাইপাস করে সংযোগ দেওয়া সংক্রান্ত দুর্নীতি, এস্টিমেশনের চেয়ে কম গ্যাস
সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো, ইচ্ছে করে ইভিসি (ইলেকট্রিনিক ভলিউম কারেক্টর) না বসানো। বিশেষ করে এসব দুর্নীতি
প্রতিরোধে কমিশনের প্রতিবেদনে ১২ দফা সুপারিশ উল্লেখ করেছেটিম। কমিশনের এই প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হলে
দুর্নীতি প্রতিরোধ সহজ হবে। এভাবে দুর্নীতি হওয়ার আগেই, তা প্রতিরোধ করা গেলে, মামলা করার প্রয়োজন পড়বে না।
তিনি আরও বলেন, সরকার যে কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে ঘোষণা দিয়েছে, কমিশন সে ঘোষণা বাস্তবায়ন
র্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক কার্যক্রম সফল করছে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এ প্রতিবেদন
প্রণয়ন করা হয়েছে। এসময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীনসরুল হামিদ দুদকের এই কার্যক্রমের প্রশংসা করে
বলেন, দুদকের এই প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে যথাযত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বমোননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান, এই মন্ত্রণালয়ে তা কার্যকরভাবে অনুসরণ
গ্যাসের কর্মকর্তারঅনিয়ম, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (জোবিঅ) প্রকৌশলী
আবু সাদাৎ মোহাম্মদ সায়েম জানান, বৈধ গ্রাহক সংখ্যা ৫২ হাজার, শিল্প গ্রাহক সংখ্যা ১৫০০। অবৈধ সংযোগকারীদের
বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় ১৫টি মামলা ও সাভার থানায় ৪টি মামলা করা হয়েছে। এসব এক একটি মামলায় আসামী করা হয়েছে
৪৭-৫০ জনের মতো, তিনি দাবি লকরেন যে, এই ১৯টি মামলায় প্রায় এক হাজার জনকে আসামী করা হয়েছে, এদের মধ্যে মাত্র
২জন আসামীকে আটক করা হয়েছে! তিনি আরও বলেন, উক্ত ব্যাপারে ্ধসঢ়;একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিযোগ দিয়েছে সরকার,
এখন থেকে তিনি বিষয়টি দেখবেন।
এ বিষয়ে আশুলিয়ার সহকারি কমিশনার (ভুমি) কর্মকর্তা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট তাজাওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ
বলেন, সরকারি সম্পদ গ্যাস অবৈধভাবে ব্যবহার করার অধিকার কারো নেই, দেশে এমনিতেই গ্যাস সংকট, সেখানে যদি চুরি
করে কেউ অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উক্ত ব্যাপারে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ ফাউজুল কবির জানান, আমি নতুন আসছি, তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিতাস কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম দুর্নীতির
ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে, সরকারের সম্পদ রক্ষায় সকলের সহযোগিতা দরকার। অনেকেরই প্রশ্ন কোন খুঁটির
জোড়ে এই সরকারি সম্পদ তিতাস গ্যাস হরিলুট করছে? শুধু আশুলিয়ায় প্রায় লক্ষাধিক অবৈধ সংযোগ রয়েছে, প্রশাসন নিরব
রহস্যজনক ভাবে নিরব রয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। উক্ত প্রতিবেদন ধারাবাহিক ভাবে চলবে।