হেলাল শেখঃ সারাদেশে থেমে নেই এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়েছে, এমএলএম প্রতারণার নতুন ফাঁদ তৈরি করে চলছে নতুন নতুন কৌশলে প্রতারণা, হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে কিছু মানবাধিকার কর্মকর্তাগণ, যাদের ভিআইপি অফিস রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
অ্যানালগ পদ্ধতি থেকে উঠে এখন চলছে ডিজিটাল ভার্সনে। সেই নব্বই দশকের জিজিএন থেকে হালের গ্রেট ওয়ান, স্পিক এশিয়া, ইউনিগেটওয়ে গোল্ডেন ট্রি, নিউওয়ে পর্যন্ত-একটাই লক্ষ্য, টাকা হাতিয়ে নেওয়া। বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে পড়ছে ডেসটিনি, ইউনি পে টু, আইসিএল, রেভনেক্স বিডির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমএলএম-প্রতারকরা। বিভিন্ন কৌশলে তারা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। তবে এখন আর কোনো পণ্য বা বৃক্ষরোপন পরিকল্পনা বা বিক্রি নয় বরং রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, কখনো বা ট্যুর ও আবাসিক হোটেল সার্ভিসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩ মাসে দ্বিগুন অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে তারা।বিশেষ করে গাছের চারা বিক্রির স্থলে এখন অনেকে বিক্রি করছে কাল্পনিক ট্যুর এবং আবাসিক হোটেল সার্ভিস। আবার অনেকেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করছে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে গেমস, বিভিন্ন কোর্স ও ভর্তির নামে বিভিন্ন দেশে সুযোগ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ডিসকাউন্ট ও পারসেন্টিজ সুবিধার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বর্তমানে খুব দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে ভুয়া ওয়েবসাইটধারী মার্কেটিং কোম্পানির সংখ্যা। অনেকেই একটি নির্দিষ্ট অর্থ জমা রাখলে বিনিময়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অর্থ দিচ্ছে। এভাবেই লোভে পড়ে মানুষ সর্বহারা হয়ে পড়ছে। কিছু প্রতারক আটক হলেও বেশিরভাগ প্রতারক চক্র তাদের প্রতারণা অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউটিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)-এর চোখে ধুলো দিয়ে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে এই এমএলএম কোম্পানিগুলো। মালয়েশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র কখনো বা যুক্তরাজ্যে থেকে ডোমেইন, হোস্টিং ভাড়া নিয়ে চলছে অনলাইন এমএলএম। ভয়ংকর “মানি গেম’র মাধ্যমে গত চার বছরে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরনো এমএলএম প্রতারকরাই এখন ধরণ এবং নাম পাল্টে প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে। বছর দুই আগেও তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া চৌরাস্তা ও ফ্যান্টসি কিংডমের সামনের ভবনে, রাজধানীর সেগুনবাগিচা, রমনা পার্ক, বিজয়নগর হোটেল ৭১, চট্রগ্রাম আগ্রাবাদ, মুরাদপুর সংলগ্ন স্থানে গোপনে সভা-সেমিনার করতো। এখন তারা বেরিয়ে এসেছে প্রকাশ্যে। প্রসিদ্ধ এই এমএলএম প্রতারকরা প্রতিষ্ঠা করেছেন নামে বে-নামে বিভিন্ন সমিতি। ডিপিএস নামক বই করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। “ডিরেক্ট সেলিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ” (ডিস্যাব) নামে এক সমিতি প্রতিষ্ঠা হয় গাজীপুরে গত বছর অক্টোবরে। তাদের নামে দেশের আনাচে কানাচে রীতিমতো সমিতি খুলে চালিয়ে যাচ্ছে এমএলএম প্রতারণা ব্যবসা।
অনুসন্ধান মতে, কথিত সংগঠন ‘ডিস্যাব’র নেতৃত্বে রয়েছে ‘এক্সিলেন্ট ওয়াল্ড’ নামক এমএলএম কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আনোয়ার এইচ রয়েল রানা। ‘ডিস্যাব’ সূত্র জানায়, উক্ত সমিতিভুক্ত প্রতিটি সদস্যেরই রয়েছে এক বা একাধিক এমএলএম মালিকানা প্রতিষ্ঠান। ওয়েবসাইট খুলে তারা নির্বিঘেœ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, ওইসব ওয়েবসাইটের রয়েছে গোপন এডমিন নাম ও পাসওয়ার্ড। শুধুমাত্র কথিত কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও ঐ পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। একজন সাধারণ মানুষ ইচ্ছে করলেই তাদের পাসওয়ার্ড বা নির্দেশনা অনলাইনে জানার সুযোগ নেই। তাদের প্রতারণামূলক সব কাজ হয় অনলাইনে গোপনীয়তায়।‘ই-কামর্স লিমিটেড’ নামক ওয়েবসাইট খুলে এমএলএম কোম্পানি পরিচালনা করছেন এম আরিফ হাসান। এছাড়া অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত আব্দুল মালেক স্বাধীনের মালিকানায় রয়েছে ‘ওয়ালমার্ক এমএলএম লিমিটেড’ নামক এমএলএম নেটওয়ার্ক। ‘উইনলাইফ গেøাবাল লিমিটেড’ পরিচালনা করছেন মো: মনিরুল ইসলাম কাইয়ুম। রাজধানীর মোতালেব প্লাজাসহ হাতিরপুলেই প্রায় ৩০টির মতো এমএলএম কোম্পানির ব্যবসা বাণিজ্যের কার্যালয় রয়েছে। কোনো অফিস চটকদার আবার কোনটার সাইনবোর্ড, আইডি, অফিস সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই প্রতারিত হয় মানুষ। জানা গেছে, প্রতারক চক্রের কিছু সদস্য ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, উত্তরা, মিরপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় নানারকম নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছে। যেমনঃ রাজনৈতিক নেতা, “ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া মানবাধিকার কর্মী, ভুয়া ডিবি, ভুয়া র্যাব।” এদিকে প্রতারক চক্র ও কিশোর গ্যাং মাদক সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং প্রতারণাসহ নানারকম অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছে। অভিযোগ রয়েছে যে, প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রায় সব এলাকায় প্রতারক, মাদক সন্ত্রাস ও বিভিন্ন অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তথ্যসূত্রঃ গত (৯জানুয়ারি ২০২১ইং) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ‘তানহা এসোসিয়েটস লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি সাধারণ জনগণের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে আশুলিয়া থানাধীন ‘তানহা এসোসিয়েটস লিমিটেড’ এর অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রতারকদের ৪জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো-ঢাকার সবুজ কাজী (৩৩), খুলনার শাওন মহলদার (২০), বরগুনার মাহবুব আলম (৪৫), সিরাজগঞ্জের মোঃ আমিনুল ইসলাম (৪০)। এছাড়াও প্রতারকদের নিকট হতে ১৫জন চাকুরী প্রার্থী ভুক্তভোগীসহ ২০০টি রেজিস্ট্রেশন ফরম, ১০০টি নিয়োগ বিঃ ৫০টি অঙ্গীকারনামা, ৩০টি যোগদানপত্র, ৫০টি অব্যাহতি ফরম, ২টি টাকা জমাদানের রশিদ, ১০টি পরিচয়পত্র ও ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
উক্ত গ্রেফতারকৃতরা তাদের নিজ নিজ কৃতকর্মের বিষয়ে র্যাবের কাছে অপরাধ স্বীকার করার পাশাপাশি জানায় যে, তারা রাজধানীসহ ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় অফিস ভাড়া করে বিভিন্ন নামে বেনামে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান খুলে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে আসা মধ্যশিক্ষিত বেকার ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যুবক/যুবতীদের আকর্ষনীয় উচ্চ বেতনের চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত প্রতারণা করে চক্রটি। ভুক্তভোগী জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করে প্রতারকরা। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতারক সদস্যদেরকে গ্রেফতার করার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে বলে র্যাব জানায়। অদূর ভবিষ্যতে এরুপ অসাধু নব্য প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে র্যাব-৪ এর জোড়ালো সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে গণমাধ্যমকে জানান, র্যাব-৪ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর এ এইচ এম আদনান তফাদার। তিনি বলেন, দেশের সহজ সরল মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন অংকের টাকা। আমরা তাদেরকে আটক করেছি, তাদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অপরাধী সে যেইহোক না কেন তাদেরকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও এই র্যাব কর্মকর্তা জানান। এর আগে আশুলিয়ার জামগড়া চৌরাস্তায় একটি ভবনে র্যাব-৪ এর অভিযানে ১২জন প্রতারককে গ্রেফতার ও ১০৪ জন ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, এই ধরণের অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য থাকলে এবং জিডি বা অভিযোগের বাদি পেলে, র্যাব কর্তৃক তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে, এ বিষয়ে জোড়ালো সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। আশুলিয়া থানা পুলিশ জানায়, উক্ত ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় একাধিক মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত চলছে বলেও একাধিক পুলিশ অফিসার জানান। পুলিশের দাবি-অপরাধী সে যেই হোক না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
উক্ত অব্যাহত এমএলএম প্রতারণার বিষয়ে ‘হিউম্যান রাইটস ্যাান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমকে জানান, এমএলএম দ্বারা প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মানুষের অসেচেতনতা ও লোভ। এসব প্রতারকদের টার্গেটই থাকে সহজ-সরল মানুষ। তারা প্রলোভনে পড়ে অর্থলগ্নি করে। পরে নিজেরাই প্রতারিত হয়। তিনি আরও বলেন, এমএলএম রোধে কার্যকর আইন হওয়া খুবই জরুরি।
