প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার হাট বসত। সেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কবেই। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নির্মম আঘাতে নিম্নআয়ের মানুষগুলো দু’বেলা রুটিরুজির জন্য আজও নিজেকে বেচে দেন মানুষের হাটে। শুনতে যদিও অবাক লাগে আসলে সেটাই বাস্তব।
চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বড়পোল এলাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চত্বরে এর সামনে প্রতিদিন বসে দিনমজুরের হাট, ভোর ৫ থেকে একজন দুজন করে আসতে থাকেন তারা।
সূর্য যখন মোটামুটি আলো ছড়িয়ে পূর্ণদমে দিনের যাত্রা শুরু করে, টিক তখন দিনমজুর লোক গুলো শঙ্কায় শ পাঁচেক হয়ে যায়।
তাদের কারো হাতে কোদাল, কারোওবা হাতে কর্নি, অথবা মাটির টুকরি, রঙের বালতি, নয়তো বা হাতুড়ি বাটাল।
তারা সবাই দিনমজুর ,শ্রম বিক্রি করে ঘুরে জীবনের চাকা, সেই শ্রম বিক্রির জন্য প্রতিদিন ক্রেতার আশায় এখানে এভাবেই ভিড় জমায় তারা। এসব দিনমজুরের কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ কাঠমিস্ত্রি, অথবা কেউ মাটি কাটার শ্রমিক, রংমিস্ত্রি, কেউ আবার বালু ও রড টানা শ্রমিক।
সংসার চালানোর জন্য নিজেকে প্রতিদিন বিক্রি করতে আসেন মানুষের হাটে এমন কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টিবাদল মৌসুম হওয়ায় এখন নির্মাণ কাজ কমে গেছে, ভেকু মেশিন দিয়ে মাটিকাটায় , শ্রমিকদের কাজের পরিধি সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সকাল পাচটা থেকে অপেক্ষা করেন কাজের জন্য কিছু শ্রমিক, কারো ভাগ্যে কাজ জোটে আবার কারো ভাগ্যে কাজ জোটে না।
সকাল ৫ টার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে অনেক দিন মজুর শ্রমিক ভিড় জমিয়েছেন, তাদের কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, আবার জিনিসপত্র কাছে রেখে বসে আছেন কেউ, কাজের জন্য শ্রমিক প্রয়োজন এমন লোক আসলেই, অনেকে ঘিরে ধরছেন তাকে, তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
নেত্রকোনা জেলার মদন থানার মাটিকাটা শ্রমিক মোঃ জজ মিয়া জানান, প্রতিদিন সকালে কাজের জন্য এখানে আসেন, তার মত আরও অনেকে হালিশহরের বড় পুল মানুষের হাটে কাজের জন্য আসেন ,অনেক শ্রমজীবী বিক্রি হলেও অনেকেই থেকে যান অবিক্রীত তারা বাড়িতে ফিরে যান।
মাটিকাটা শ্রমিক রুকন মিয়া বলেন, মাসে অর্ধেক দিন কাজ হয় না, তখন আমাদের চলতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়,
কিশোরগঞ্জ জেলার শ্রমিক মুর্শিদ মিয়া বলেন,
শ্রমিকদের প্রায় সবাই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে,
তারা কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না,
রাউতি গ্রামের শ্রমিক-মানিক হোসেন বলেন,
৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছিলাম, দুই-তিনটা এনজিওতে থেকে,
কিস্তি পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে তারা। বৃষ্টি বাদলের দিন হওয়াতে আগের মতো কাজও পাচ্ছিনা এখন কি করব ভেবেও পাচ্ছিনা।
কিশোরগঞ্জের নিকলী এলাকার, শাহাদত ও চান মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, করোনার মধ্যে আমরা না খেয়ে দিন পার করছি। তারপর সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। যখন যে কাজ পাই সেই কাজ করি। আমাদের সন্তানেরা নিজেরাই চলতে পারে না, আমাদের কি দেখবে? তাই প্রতিদিন কামলা দিতে হয়। কামলার হাটে দাম একটু বেশি পাই। কেউ কিনলে, কোনো দিন ৫০০ আবার কোনো দিন ৬০০ টাকা থাকে।
মানুষ কিনতে আসা শফিক তিনি বলেন, শ্রমিকের দাম একটু বেশি হলেও এখানে সহজে কাজের লোক পাওয়া যায়। একজন ইট, বালু ও মাটি সরানোর জন্য মানুষ নিতে এসেছি নিয়েছি ৫০০ টাকায়। মানুষের এই হাটে বেচাকেনা চলে কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। দাম দর ঠিক হয়ে গেলে শ্রমজীবী মানুষগুলো রওনা হন মালিকের গন্তব্যে।
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা-৬টা পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেন কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো। মজুরি বুঝে পেলে এবার বাড়ি ফেরার পালা।
এরপর আরো একটি ভোরের অপেক্ষা, কাজের জন্য ছুটেচলা মানুষের হাটে। কয়েক যুগেরও বেশি আগে থেকে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর বড় পোল এলাকায় এখানে মানুষের হাট বসে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিতই মানুষ বেচাকেনা হয়। তবে হালিশহরের বড় পুল এলাকায় নিয়মিত হাট বসলেও মানুষের হাটে নেই কোনো খাজনা, সমিতির ঝামেলা, হাট কমিটির চাঁদাবাজি। নিজের আপন গতিতেই চলে এই হাট। শ্রমজীবী মানুষেরা সেদিক দিয়ে শান্তিতে থাকলেও তাদের কাজের নিশ্চয়তা এবং জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, সরকারি কোনো বরাদ্দ আসে তাহলে তাদের সহযোগিতা করা হবে, দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলা থেকে অভাবী মানুষগণ চট্টগ্রামে শ্রম বিক্রি করতে আসেন। সড়কের পাশে তাঁদের অবস্থান একটু ঝুঁকিপূর্ণ। তবে নির্দিষ্ট একটি নিরাপদ স্থানে শ্রমিকদের বসানো যায় কি না, ভেবে দেখা হচ্ছে।