জাহিদ হাসান
সরকার চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি অটোমেশনে (স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়) রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। এর আওতায় ভূমি-সম্পর্কিত ১৭টি সেবা ডিজিটালি প্রদান এবং একক মালিকানা সনদ বা সার্টিফিকেট অব ল্যান্ড ওনারশিপ (CLO) চালুর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্প প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে জমির মালিকানা প্রমাণে বহু দলিলপত্রের প্রয়োজন হবে না। বরং মালিকানা নির্ধারণে একক দলিল হিসেবে কাজ করবে ‘ভূমি মালিকানা সনদ’ বা স্মার্ট কার্ড।
সেবার পরিধি কী থাকবে?
প্রকল্পটির আওতায় একটি ‘ল্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস ফ্রেমওয়ার্ক’ (LISF) সিস্টেম চালু করা হবে, যার মাধ্যমে দেশের ৫,২৪৭টি ভূমি অফিসে একযোগে সেবা প্রদান করা যাবে। গ্রাহকেরা অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে নিচের ডিজিটাল সেবা নিতে পারবেন—
ই-মিউটেশন
রিভিউ ও আপিল মামলা ব্যবস্থাপনা
অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ
রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা
মিউটেটেড খতিয়ান ও ডিজিটাল রেকর্ড
মৌজা ম্যাপ সরবরাহ
কৃষি ও অকৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা
দেওয়ানি মামলা মনিটরিং
হাটবাজার, জলমহাল, বালুমহাল, চা-বাগান, ভিপি সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা
ভূমি অধিগ্রহণ ও অভ্যন্তরীণ বাজেট নিয়ন্ত্রণ
ভূমি স্মার্ট কার্ড ও মালিকানা সনদ
সরকার পূর্বেই “ভূমি স্মার্ট কার্ড” চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার মাধ্যমে জমির প্রকৃত মালিক পরিচিত হবেন। এই কার্ড থাকলে মালিকানার প্রমাণে আলাদা দলিলপত্রের প্রয়োজন হবে না এবং এটি ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের কাজেও ব্যবহৃত হবে।
তবে ‘ভূমি মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩’ এখনো কার্যকর না হওয়ায় স্মার্ট কার্ড কার্যক্রম স্থবির ছিল। সূত্র জানিয়েছে, আইনটি কেবিনেট অনুমোদন পেলেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে এবং এরপর ধাপে ধাপে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হবে।
আর্থিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৯১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর আওতায় সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও প্রশিক্ষণের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে—
ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প (১১৯৭ কোটি টাকা)
ডিজিটাল জরিপ সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্প (১২১২ কোটি টাকা)
এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ৩০ জুন ২০২৫ এর মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
অগ্রগতি ও জনসেবা
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৮ লাখ নাগরিক অনলাইনে ভূমি কর পরিশোধের জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০% নাগরিক স্বচ্ছভাবে কর পরিশোধ করেছেন এবং ৫০% হয়রানি কমেছে। প্রতিদিন ৩০–৪০ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
সরকার জনবান্ধব ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে— স্টেশন, বিপণি বিতান, উপজেলা কমপ্লেক্সে— ভূমিসেবা কিয়স্ক স্থাপন করছে, যেখানে নাগরিকেরা ফি দিয়ে জমির খতিয়ান বা ম্যাপ প্রিন্ট করতে পারবেন ও খাজনা দিতে পারবেন।
আইনের খসড়া ও দণ্ডসংক্রান্ত বিধান
টানা তিন বছর খাজনা না দিলে জমি বাজেয়াপ্ত হয়ে খাস জমি হিসেবে গণ্য হবে।
মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি মালিকানা সনদ হালনাগাদ করতে হবে।
চলাচলের পথ বন্ধ করে দিলে সেটি হবে অপরাধ, যার জন্য এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
নীতিনির্ধারকদের মতে, দেশের ৮০% ফৌজদারি মামলার মূল কারণ জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ। আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ এই সমস্যার নিরসনে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।