গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ দিবাগত রাত ডেমরায় অছিম পরিবহনে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় জড়িত তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও উক্ত ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়ি জব্দ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি’র স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের এন্টি ইললিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম।
গ্রেফতারকৃতদের নাম-ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ নুরুল ইসলাম মনির ওরফে মনির মুন্সি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মোঃ সাহেদ আহমেদ এবং বিএনপি কর্মী ও মনির মুন্সির ব্যক্তিগত ড্রাইভার মাহাবুবুর রহমান সোহাগ।
আজ শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মোঃ আসাদুজ্জামান, বিপিএম (বার)।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব পরিচালনা করে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করার মত জঘন্য কাজসহ অসংখ্য গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর ভোরে ডেমরার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহনের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের দেয়া আগুনে ঐ বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মোঃ নাইম ঘটনাস্থলে আগুনে পুড়ে মারা যায় এবং অপর হেলপার মোঃ রবিউল অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়। এ সংক্রান্তে ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর ডেমরা থানায় একটি মামলা রুজু হয়। ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর মামলাটি হস্তান্তর করা হয় সিটিটিসি’তে। মামলাটি তদন্ত শুরু করে সিটিটিসি’র স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের এন্টি ইললিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম।
অগ্নিকাণ্ডে ব্যবহৃত গাড়ি ও মোটরসাইকেল
তিনি আরো বলেন, তদন্তের শুরুতে দুইজন ভিকটিমের খোঁজ নিয়ে জানা যায় মৃত মোঃ নাইমের বাড়ি বরিশালের কোতয়ালি থানা এলাকায়। তার বাবার নাম আলম চৌকিদার এবং মায়ের নাম পারভিন বেগম। তারা ডেমরা এলাকাতেই থাকতেন। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা ফিরানোর জন্যই অল্প বয়সে কাজে নেমে পরেন। অবশেষে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বাসের ভিতর ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের জীবন বিসর্জন দেন। অপর ভিকটিম মোঃ রবিউল একই বাসে নাইমের সাথে ঘুমিয়েছিলো। ঘুমের মাঝে আচমকা আগুনের তাপে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার কিন্তু ততক্ষণে রবিউলের শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সে কোনমতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। সে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে মুক্ত হলেও এখনো শরীরে পোড়া দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পড় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনাস্থলের চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি সনাক্ত করা হয় যা ঐদিন অগ্নিসংযোগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই গাড়ির সূত্র ধরে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মূল অগ্নিসংযোগকারী ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার এবং ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ২৮ অক্টোবরের ধারাবাহিকতা এবং তাদের এই নাশকতা অব্যাহত রাখার জন্য মনির মুন্সি তার নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পায়। নির্দেশনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নাশকতার মাত্রা আরও বাড়ানো এবং এমন কোন ঘটনা ঘটানো যাতে করে জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তারই অংশ হিসেবে সে বেশ কয়েকজনকে অগ্নিসংযোগের জন্য নিয়োগ দেয় এবং সে নিজে বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য তার অপর সহযোগী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিব এবং তার বন্ধু সাহেদ আহমেদকে ডেকে নেয়। তারা দুজনে মিলে একটি পরিকল্পনা করে এমন একটি ঘটনা ঘটাবে যাতে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে ডেমরা এলাকার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ড এলাকায় রাত দুইটার পর বেশ কয়েকবার গাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে রেকি করে এবং দেখতে থাকে কোন জায়গাটা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতামুক্ত। অবশেষে তারা কাঙ্ক্ষিত টার্গেট ফিক্স করে বড়ভাঙ্গা মার্কেটে চলে যায়। সেখান থেকে তারা দুই লিটারের পানির বোতলে পেট্রোল সংগ্রহ করে আনুমানিক ভোর তিনটায় ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ঘটনাস্থলের নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে চালক মাহাবুবুর রহমান সোহাগ গাড়িতে অবস্থান করে এবং মনির মুন্সি ও সাহেদ পেট্রোলের বোতল নিয়ে রাস্তার পাশে পার্কিং করে করা অছিম পরিবহনের গাড়ির কাছে যায়। সেখানে গাড়ির চালকের সিটের পাশে থাকা খোলা গ্লাসের মধ্য দিয়ে চালকের সিটে মনির মুন্সি পেট্রোল ঢেলে দেয়। এরপর সে দিয়াশলাই দিয়ে পেট্রোলে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিমিষেই গাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগিয়ে তারা গাড়িতে করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। তারা এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য উল্টা পথে ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে সুফিয়া কামাল ব্রিজ দিয়ে ভুলতায় থাকা মনির মুন্সিদের মালিকানাধীন ‘মুন্সি পেট্রোল পাম্প’-এ রাত্রি যাপন করে। সকাল দশটার দিকে তারা পেট্রোল পাম্প হতে বাসায় চলে যায়।