ফেনীতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, নেপথ্যে ক্ষমতাধর ‘বড় ভাইয়েরা’
ফেনীতে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, ছিনতাই, দখল বাণিজ্য ও অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়েই চলেছে। এসব অপকর্ম যারা করছে তাদের বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ। তবে নেপথ্যে থাকেন ‘বড় ভাইয়েরা’। তারা এলাকায় প্রভাব বিস্তার, কোনো ব্যবসায়ী বা বিপক্ষের নেতাকর্মীকে ধমকানো-শাসানো, জমিজমা বাগিয়ে নেওয়াসহ নানা স্বার্থ উদ্ধারে সন্ত্রাসীদের লালন করেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয়প্রশ্রয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত দুই ডজন কিশোর গ্যাং।
যে বয়সে বিদ্যালয়ে থাকার কথা সেই বয়সে রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধ করে বেড়ালেও এ সন্ত্রাসীদের যেন সাত-খুন মাফ হয়ে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণকারীদের ইশারায়। এই বড় ভাইদের অনেকে ক্ষমতাসীন দলের পদে থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
স্কুল-কলেজ ছুটি হওয়ার আগে ও পরে ক্যাম্পাসের আশপাশে ঘুরঘুর করে বখাটেরা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে অভিভাবকরা মেয়েদের বিদ্যালয়েো আনা-নেওয়া করেন। স্থানীয়রা জানান, সদরসহ ছয় উপজেলার প্রায় সাড়ে তিনশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরো সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরঘুর করে বখাটেরা। এসব মোটরসাইকেলের অধিকাংশই নম্বরবিহীন। আবার অবৈধভাবে লাগানো হয়েছে উচ্চশব্দের যন্ত্র। এতে তাদের চলাফেরায় বিরক্ত হন পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দারা। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে রাস্তায় একা চলা দায়। তারা আড্ডাবাজি ও মাদকে জড়ানোয় অভিভাবকরা ছেলে সন্তানকে নিয়েও থাকেন উদ্বিগ্ন। বখাটে-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের লালনকারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের শিকারে পরিণত হতে হয়।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে গত ২৯ তারিখ প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কেরোসিন ঢেলে এক কলেজছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করারও সাহস পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার। এর আগে গত ৩০ তারিখ শহরে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে ভাঙচুরসহ অন্তত ১০ জনকে কোপানো হয়।
অধিক প্রভাবশালী কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে আছে ঘোপাল গ্রুপ, প্রি এক্স টেন, বাপ্পি গ্রুপ, ফাজিলপুর গ্রুপ, সি এক্স টেন, শাহীন একাডেমি গ্রুপ, পি এক্স, বাদশা গ্রুপ, গ্যাং স্টার, লাঙলমোড়া গ্রুপ, চাঁদগাজী গ্রুপ। এসব গ্যাংয়ের প্রধান হিসেবে নাফিজ, ফারাবি, মাহির, বিপ্লব, ফাহিম, আসাদ, ইমাম সোহাগ, ওমর ফারুক, সাইমুন স্বাধীন, নুরুল ইসলামের নাম জানা গেছে।
তাদের আড্ডার শতাধিক জায়গার মধ্যে সদরের পৌরসভা কার্যালয়ের আশপাশ, রাজাঝি দিঘির পার্ক, মহিপাল ফ্লাই ওভার এলাকা, মহিপাল বিজয় সিংহ দিঘির পার্ক, হাসপাতাল মোড় উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গায় তারা বিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশের সময় সকাল ১০টা, বিকেল ৫টায় বের হওয়ার সময় ছাড়াও ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করে।
ফাজিলপুর গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন ঘোপাল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক যোবায়ের পারভেজ। তাঁর নামে মাদক, খুন, ডাকাতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলাসহ ১৭টি মামলা আছে। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত নই। গ্যাংলিডার বলা হয় ষড়যন্ত্র করে। মামলাগুলোও সাজানো।’
পি এক্স ও সি এক্স টেন নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে প্রভাব বিস্তারকারী নাফিজ। সম্প্রতি একটি অবৈধ অস্ত্রের দখল নিয়ে তাঁর গ্রুপের সঙ্গে অন্য একটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় নাফিজ বলেন, ঘটনাটি অস্ত্র নিয়ে নয়, পূর্ব বিরোধের জেরে।
ঘোপাল গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মোহাম্মদ তানভীর ভূঁইয়া। এই গ্যাং দিয়ে তিনি মাদক কারবারসহ নানা অপকর্ম চালান। সম্প্রতি র্যাবের ওপর হামলার অভিযোগে তাঁর নামে মামলা হয়। ওই সময় জেলা ছাত্রলীগ তানভীরকে পদচ্যুত করলেও কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়নি। এমনকি ফেসবুক প্রোফাইলেও তাঁর নামের পাশে সভাপতি পদবি বহাল আছে। তানভীর বলেন, ‘আমার সঙ্গে থাকা ছেলেরা কোনো ঝামেলা বা অন্যায় কাজে জড়িত নয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ সেলিম এবং তাঁর অনুসারী যুবলীগ নেতা হানিফ বাবুল। এই দুই নেতার গ্রুপের ছেলেরাই এলাকায় চুরি-ছিনতাই করছে।’
এ বিষয়ে জানতে সেলিম চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি জবাব দেননি।
জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তপু বলেন, ছাত্রলীগের কেউ কোনো গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে না। এলাকার কিশোর-তরুণরা দল বেঁধে ঘুরে, কিন্তু ঝামেলা হলে তারা রাজনৈতিক নেতাদের নাম নেয়। আমাদের কাছে এলে মীমাংসা করে দিই। এটিকে কিশোর গ্যাং লালন বলা ভুল হবে।
শাহীন একাডেমি গ্রুপের নিয়ন্ত্রক পৌরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শুভ বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি বলে কিছু ছাত্র ও কিশোর আমার সঙ্গে আছে। তবে তারা অপরাধ করে না।’
এদিকে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণকারীরা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীর অনুসারী বলে পরিচয় দেন। এ বিষয়ে মেয়র স্বপন বলেন, ‘আমি কোনো গ্যাং লালন করি না। এরা আমারও না, কারও না।’
স্থানীয় সাংবাদিক সৈয়দ মনির আহমেদ বলেন, ‘আমার বাড়ি সোনাগাজী হলেও সেখানে থাকতে পারিনি। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় আমার ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালায় কিশোর গ্যাংসহ দুর্বৃত্তরা। বাধ্য হয়ে ভিটা ছেড়েছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে থাকি।’
দাউদপোলের এক পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফেনীতে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং সদস্যরা চাঁদা দাবি করে আসছে। বিষয়গুলো স্থানীয় প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের জানালে কিছু দিন বন্ধ থাকে, পরে আবার শুরু হয়।
এক কিশোরের অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ছেলেকে ঢাকা পাঠিয়ে সেখানে স্কুলে ভর্তি করি, কিন্তু রাখতে পারিনি। ছেলেটির বাবা মারা যাওয়ায় আমি এখন দিশেহারা। এলাকার পরিবেশ ভালো না হলে এই সমাজে থাকাই বিপজ্জনক।
ফেনী আদালতের আইনজীবী ও খেলাঘর জেলা শাখার সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম নান্টু উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, যে হারে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে তাতে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। যারা এদের নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই।
দাগুন ভুঞা উপজেলা দাগনভূঞা বাজার আশেপাশে ৪ নং রামনগর ইউনিয়ন তুলাতুলি বাজারে সেবারহাট বাজারে কিশোর গ্যাং হামলায় দুইজন স্পট ডেট সহ অনেক অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে এদের যেন থামাবার কেউ নেই কিশোর গেং নিয়ন্ত্রণে শুধু প্রশাসন একার পক্ষে সম্ভব না সামাজিক ও পারিবারিক সুশিক্ষার প্রয়োজন,
ফেনী জেলা যুবলীগের সভাপতি দাগুণ ভুঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন একটি অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যের মাধ্যমে বলেন আজকের কিশোর গ্যাং আগামী দিনে ডাকাত দলের সদস্য,
পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে আমি অবগত। কিছুদিনের মধ্যে ফেনীকে কিশোর গ্যাংমুক্ত করা হবে।
ফেনী-২ (সদর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, কিশোর গ্যাং নির্মূলে প্রশাসনকে একা দায়ী করা যাবে না। এখানে অভিভাবকদেরও সচেতনতা প্রয়োজন। তবে শিগগিরই এ জেলাকে সবার বসবাসের উপযোগী করা হবে।