শাহীন আহমেদ
উপরে তাকালে দেখা যায় দাউ দাউ করে বের হচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, এলাকায় যেন বোঝার উপায় নেই কখন সন্ধ্যা কখন সকাল ,আর নিচে সড়ক, যানবাহন, ভবন সবকিছু ধোঁয়ার আঁধারে ঢাকা। খোলা চোখেও মনে হয় যেন সূর্যকেও ঢেকে দিচ্ছে ইস্পাতের কালো ও ধূসর ধোঁয়া। শুধু মানুষ নয় মনে হবে যেন নগরীও ধুঁকছে শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণায়। এ দৃশ্য চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের রুবি গেইট এলাকার। এখানে লোহার রড তৈরির বিশাল বড় একটি কারখানা রয়েছে, নাম সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ। সালেহ স্টিলকে নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন এলাকাবাসীরা এবং করছেন হাজারো অভিযোগ। শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, সালেহ স্টিল প্রভাবিত করছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকেও।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে অনুসন্ধানী টিম। এ সময় দেখা যায়, দুই নম্বর গেট থেকে অক্সিজেন রুট সড়কের রুবি গেইট এলাকায় মূল সড়কের একপাশে সালেহ স্টিল অবস্থিত। সালেহ স্টিল প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় কুণ্ডলী আকারে ধোঁয়া ছাড়ে এবং চিমনি থাকলেও তারা তা ব্যবহার করে না। ফলে ধোঁয়াগুলো মূল সড়কে চলে আসে। এসব দেখে মূল সড়ক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন বলে দৃষ্টিভ্রম হবে যে কারও এবং মনে হবে যেন শীতের সকাল।
স্থানীয়রাও অভিযোগ তুলেছেন সালেহ স্টিল কারখানার উপর। তারা বলছেন, মূল সড়কে যে ধোঁয়াগুলো আসছে তার ৮০ শতাংশই সালেহ স্টিল থেকে। কারখানাটির ২০ ফুট দূরত্বের মধ্যে রয়েছে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও আবাসিক ভবন। আশপাশে রয়েছে রুবি ফুড প্রোডাক্টসসহ বিভিন্ন খাবার দোকান, যানবাহনের যন্ত্রাংশের দোকান, ওয়ার্কশপ, মুদি দোকানসহ আরও প্রতিষ্ঠান। এ ধোঁয়ার কারণে শুধু বায়ু দূষণ নয় মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে ওই এলাকার মানুষেরা। স্থানীয় লোক ও আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে দফায় দফায় অভিযোগ দেওয়া হলেও তা কানে তুলছে না কারখানাটির কর্তৃপক্ষ।
সাইডার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর এলেকসসেস সেরাও অনুসন্ধানী টিমকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলের পরিবেশটা খুব সুন্দর। কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো স্কুলের পাশে গড়ে ওঠা কারখানাটি। তাদের উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার সময় যে ধোঁয়া বের হয় সেটা সরাসরি স্কুল পর্যন্ত আসে। সকালবেলা আমাদের স্কুল ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। বলতে গেলে কিছুই দেখা যায় না। এ সময়ে বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট হয়, শিক্ষকদেরও কষ্ট হয়। ধোঁয়ার ক্ষতি থেকে বাঁচতে আমারা প্রায় স্কুলের দরজা ও জানালা বন্ধ রাখি। শুধু স্কুল নয়, এখানে আশেপাশে অনেক আবাসিক এলাকা রয়েছে। আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার অভিযোগ দেওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ।
এলাকার আরেক ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম বলেন, এটা যেহেতু শিল্প এলাকা ধোঁয়া তো থাকবে। তার সীমা থাকতে হয়। কিন্তু এখানে ২৪ ঘণ্টাই কুয়াশার মত ধোঁয়া থাকে হঠাৎ কেউ দেখলে মনে করবে যেন শীতের সকাল। মাঝে মাঝে এতবেশি ধোঁয়া বের হয় যে মুখে হাত চেপেও ধোঁয়া আটকানো যায় না। মানুষ অনেক বেশি ভোগান্তির মধ্যে আছে। ঊর্ধ্বতন মহলকে ম্যানেজ করে তারা আবার কারখানা চালু কর দেয়। চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিপ্তরও তাদের সাথে পেরে ওঠে না। একটা প্রতিষ্ঠান মালিকের কাছে একটা শহরের প্রশাসন এভাবে জিম্মি হয় যাবে এটা ধারণারও বাইরে।
চা বিক্রেতা মো. ইকবাল বলেন, আমি ১৪ বছর ধরে এ এলাকায় চা বিক্রি করছি। তিন বছর আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ী সালেহ স্টিল নামের ফ্যাক্টরিটা কিনে নেন। এরপর থেকেই এ অবস্থা। দিনের বেলায় ধোঁয়ার কারণে একদম অন্ধকার হয়ে যায়। আমার খাবারগুলোও ধোঁয়ার ময়লা বলে মনে হয়। সারাদিন ধোঁয়ার মধ্যে থাকি। প্রচণ্ড মাথাব্যথা করে, রাতে ঘুমাতে পারি না।
কারখানার পাশে ওয়ার্কশপে কাজ করা শ্রমিক মিলন মিয়া বলেন, ‘সারাদিন ওয়ার্কশপে কাজ করি। এখানে বেশি ধোঁয়া হলে পুরো জায়গাটা অন্ধকার হয়ে যায়। কালো ধোঁয়ায় আমাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কাজের অসুবিধা হয়। অনেক সময় আমরা কাজ ছেড়ে অন্যদিকে চলে যাই। ধোঁয়া কমলে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করি।
দিনমজুর আব্দুর রহিম বলেন, ‘সারাক্ষণ ধোঁয়া বের হতে থাকে। অথচ এ রাস্তা দিয়ে কত বড় বড় অফিসাররা যায়। তারা তো কিছুই বলে না।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাজমুল হাসনাইন নওশাদ বলেন, বহির্বিশ্বে যে মানের শিল্পায়ন হয়, আমাদের দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সে মান বজায় রাখা হয় না। কারখানার ধোঁয়া মানুষের শরীরে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। বিষাক্ত বাতাসে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন থাকার কথা। কিন্তু বিষাক্ত গ্যাস যখন মিশছে সেখানে তারতম্য হয়ে যাচ্ছে। সে বাতাস যখন আমরা টেনে নিচ্ছি তখন সেটা ফুসফুসের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এবং তিনি আরো বলেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের ক্ষেত্রে কাশি হওয়া, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ক্যান্সারের মত রোগ হবে। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে ফুসফুসের পর্দাটা শক্ত হয়ে ফুসফুসের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর এটার ফলাফল হবে খুব খারাপ। কারখানার ধোঁয়ায় একটা গ্যাস থাকে, সে গ্যাস শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাসনালীর কোষগুলো থেকে আঠালো কিছু বের হতে থাকে। এমন প্রতিক্রিয়া সাথে সাথেও হতে পারে। কাজেই কারখানার শ্রমিক, স্থানীয় জনগণকে বাঁচার জন্য সচেতন হতে হবে। নিয়মিত মাস্ক পরা, শাক-সবজি ও ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া, বছরে অন্তত একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া। এ বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।
পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সালেহ স্টিলের ডেপুটি ম্যানেজার বিল্লাল হোসেন বলেন, আমরা সবকিছু ম্যানেজ করে এই কোম্পানি চালাচ্ছি, এবং আপনারা ধোয়ার যে বিষয়টা বললেন আস্তে আস্তে আমরা সীমিত করার চেষ্টা করছি, এবং তিনি আরো বলেন, সব সেক্টরের লোকের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে, আপনাদের কিছু চাওয়ার থাকলে বলুন আমরা ব্যবস্থা করব, এবং ডেপুটি ম্যানেজার বিল্লাল হোসেন কথিত কয়েকজন সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী টিমের পিছনে লেলিয়ে দেয় ম্যানেজ করার জন্য।
ডেপুটি ম্যানেজার বিলাল হোসেন তিনি মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে অনুসন্ধানী টিমকে বলেন, ‘আপনি কারখানার ধোঁয়ার যে বিষয়টি বললেন সে বিষয়ে আমরাও অবগত আছি। ধোঁয়ার যে সমস্যাটা হচ্ছে এটা নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। ধোঁয়ার সমস্যাটার কারণে যারা ‘টুকটাক ভোগান্তি’তে পড়ছে এটা যাতে আর না হয় তা নিয়ে কাজ করছি। এ ব্যাপারে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। আশা করছি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।
তবে কুণ্ডলী কুণ্ডলী ধোঁয়া পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ব্যাপক আকারে ধোঁয়া রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে বিষয়টা কিন্তু সত্য নয়। মাঝেমাঝে হয়তো এমনটা হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি দ্রুত সময়র মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।
খুব দ্রুত সময় বলতে কতদিন লাগবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনাকে আগেই বলেছি আমরা সমস্যাটি সমাধানে পরিবেশ অধিপ্তরের সাথে কাজ করছি। যে ধোঁয়াটা বের হচ্ছে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আমি আপনাকে এক বা দু সপ্তাহের মধ্যে সমাধান করে ফেলব এমন আশ্বাস দেওয়া ঠিক হবে না।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ডাইরেক্টর সোনিয়া বলেন, সালে স্টিলের বিষয়ে কয়েকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনে আবারো ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আপনি জানিয়েছেন আমরা বিষয়টা খুব দ্রুত ভাবে দেখছি।