দালাল চক্রের মাধ্যমে ভিজিট ভিসার নামে বিমান বন্দরে একশ্রেণির অসাধু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাত করে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে নিতে সমুদ্রপথে অবৈধযাত্রা দিন দিন বাড়ছে। বিমান বন্দরে মাঝে মধ্যে ভিজিট ভিসার কিছু কিছু যাত্রীকে অফলোডও করা হয়। দালাল চক্রের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের নামে ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। ভিজিট ভিসায় দুবাই হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দিয়ে শত শত বাংলাদেশি স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাড়ি দেয়ার আশায় লিবিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পে দীর্ঘ দিন যাবত কারাবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এসব কারাবন্দি বাংলাদেশিদের জনপ্রতি দশ লাখ টাকা থেকে বারো লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। এসব দালাল চক্রের সাথে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের সখ্যতা রয়েছে। লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপলী এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম একসঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করতে হিমসিম খাচ্ছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। লিবিয়ার মিসরাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী ১৫৭ জন আটকে পড়া অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিককে আজ শুক্রবার সকালে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপলী, লিবিয়া ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহযোগিতায় এদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদিকে, পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশে ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিদের পাঠাতে মানবপাচারকারীদের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিমান বন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের হাত করে ভিজিট ভিসায় পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে বাংলাদেশি যুবকদের বেশি বেতনে চাকরি দেয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মানবপাচারকারীরা। ফলে অনেকেই কাজ না পেয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার এসব দেশে গমনেচ্ছুদের ওপর সতর্কতা জারি করেছে। বিশ্বের পাঁচ দেশে গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের জন্য সতর্কতা দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সেগুলো হচ্ছে, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। এসব দেশে গমনেচ্ছু বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবাসী কিছু অসাধু ব্যক্তি ও এসব দেশে গড়ে ওঠা বেশ কিছু স্ক্যাম প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে জিম্মি করার তথ্য মিলেছে। এ অবস্থায় বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের এসব দেশে কম্পিউটার পরিচালনা সংক্রান্ত চাকরির প্রস্তাব পেলে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশি নাগরিকদেরকে প্রবাসী কিছু অসাধু ব্যক্তি ও এসব দেশে গড়ে ওঠা বেশ কিছু স্ক্যাম প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার অপারেটর, টাইপিস্ট, কলসেন্টার অপারেটরসহ বিভিন্ন পদে আকর্ষণীয় বেতনের প্রলোভন দিয়ে নিয়োগের লক্ষ্যে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে (ভুয়া ওয়েবসাইট, ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ইত্যাদি) প্রচার কার্যক্রম,নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছে। এসব ক্ষেত্রে স্ক্যাম সেন্টারগুলো বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরকেও সুকৌশলে স্ক্যাম সেন্টারের ভেতরে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক জিম্মি করে স্ক্যামের কাজে নিয়োজিত করছে। ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাস মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ায় গড়ে ওঠা স্ক্যাম সেন্টারগুলো থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ও পালিয়ে আসা বেশ কিছু বাংলাদেশিকে এরই মধ্যে দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এসব দেশে সাইবার স্ক্যাম নিয়ে কাজ করছে এ ধরনের এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের এসব দেশে কম্পিউটার পরিচালনা সংক্রান্ত চাকরির প্রস্তাব পেলে অধিক সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হলো। প্রয়োজনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। অথবা জনশক্তি, কর্মস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য যাচাই করে নিতে অনুরোধ করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এছাড়াও স্ক্যাম সেন্টার থেকে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ আইডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে-বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের টার্গেট করে আর্থিক প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশে-বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগ করলে প্রতারক চক্র তাৎক্ষণিক এসব লেনদেনের অ্যাকাউন্ট বন্ধের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে। এ বিষয়ে দেশে-বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিএমইটির সূত্র জানায়, গত ১ জানুয়ারি থেকে গত ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৩৯৭ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকরি লাভ করেছে। বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৬ দিনে দেশে বৈধপথে ১২৫ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৬২ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। সে হিসেবে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বা ৯৪১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত সবশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বৈধভাবে কর্মী গমনের সংখ্যা আরো বাড়লে রেমিট্যান্স খাতে আরো গতি বাড়তো বলে অভিজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করেন।আজ ভোরে বুরাক এয়ারের (ইউজেড ০২২২) একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে লিবিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে প্রতারণার শিকার ১৫৭জন বাংলাদেশি যুবক ঢাকায় ফিরেছে। প্রত্যাবাসনকৃত অসহায় এ সকল বাংলাদেশি নাগরিককে বিমানবন্দরে অবতরণের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর কর্মকর্তাবৃন্দ হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান।প্রত্যাবাসিত বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই সমুদ্র পথে অবৈধভাবে ইউরোপ গমনের উদ্দেশ্যে মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় লিবিয়ায় অনুপ্রবেশ করেছিল। তাদের অধিকাংশই লিবিয়াতে বিভিন্ন সময়ে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হন। দেশে ফেরত আসার পর এই ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে আর যেন কেউ লিবিয়াতে না যায় এ বিষয়ে তাদেরকে সচেতন হওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সবাইকে আহ্বান জানান। আইওএম-এর পক্ষ থেকে লিবিয়া থেকে প্রত্যাবাসনকৃত প্রত্যেককে ছয় হাজার টাকা, কিছু খাদ্য সমগ্রী উপহার, মেডিক্যাল চিকিৎসা ও প্রয়োজনে অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টোরে আটক বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপলি এবং আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)এক সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে এখনো শত শত বাংলাদেশি যুবক দালাল চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। গত ১৩ নভেম্বর লিবিয়ার বেনগাজী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছায় দেশে আসতে ইচ্ছুক এমন ১৪৩ জন অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরেছেন। আরেক ফ্লাইটে তিউনিশিয়ায় আটকে পড়া ১৮ জন অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিকও দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশ দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর সহযোগিতায় তারা দেশে ফিরেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র আরও জানায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ দূতাবাস, ত্রিপোলির প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় লিবিয়ায় আটকে পড়া অন্য বাংলাদেশিদেরও দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এরই ধারাবহিকতায় খুব শীঘ্রই অনিয়মিত অভিবাসীদের লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রত্যেক প্রত্যাবাসনকারীকে খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসা সেবা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অস্থায়ী বাসস্থানসহ ৬ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। ফিরে আসা বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই সমুদ্রপথে ইউরোপে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রবেশ করেছিল। মূলত মানব পাচারকারীদের প্ররোচনায় পড়ে এ কাজ করেন তারা। তাদের অনেকেই লিবিয়ায় থাকাকালীন অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ১০ অক্টোবর বুরাক এয়ারের একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে লিবিয়ায় আটকে পড়া ১৫০ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। এ সময় প্রত্যাবাসনকৃত বাংলাদেশি নাগরিকদের বিমানবন্দরে অবতরণের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইওএমের কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান। স্বপ্নের দেশ ইউরোপে প্রবেশের নামে ভূ-মধ্যসাগরে নৌকাযোগে বাংলাদেশিদের অবৈধযাত্রা দিন দিন বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মাইগ্রেন্টস ফাউন্ডেশন (বিএমএফ) এর চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জয় আজ শুক্রবার ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ উপায়ে দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে কাজ না পেয়ে টাকা ফেরত চাইলে হুমকির শিকার হচ্ছেন অনেকে। তিনি বলেন, ইউরোপের সম্ভাবনায় শ্রমবাজার রক্ষায় বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, অভিবাসনের নামে মানবপাচার এবং অবৈধ অভিবাসনের জীবনের ঝুঁকি এবং ভায়বহ বিপদের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক সকল বাংলাদেশিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে এনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানান তিনি।