দেশজুড়ে নীরবভাবে বেড়ে চলেছে অনুমোদনহীন ছোট আকারের পণ্য উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা। এইসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে হুইল পাউডার, ভিম সাবান ও বিভিন্ন ধরনের লিকুইড ক্লিনার। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত করা এসব পণ্য নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম, লোগো ও সরকারি অনুমোদনের প্রতীক ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে, যার ফলে সাধারণ ক্রেতারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং ভোক্তা অধিকার হুমকির মুখে পড়ছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এসব কারখানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আবাসিক এলাকা বা গুদাম ঘরের আড়ালে পরিচালিত হচ্ছে। তদারকির অভাব ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় এসব কার্যক্রম দিনের পর দিন চালু থাকছে।
কারখানাগুলোর উৎপাদিত নকল পণ্যগুলোর মোড়কে ব্যবহৃত হচ্ছে বিএসটিআইর লোগো ও ভুয়া সনদ নম্বর, যা ক্রেতাদের কাছে একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস সৃষ্টি করে। বাজারে এসব পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত মান ও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে থাকে বড় রকমের ঘাটতি। অনেক সময় এসব রাসায়নিক দ্রব্য ত্বকে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
একজন বাজার বিশ্লেষক ও ভোক্তা অধিকার বিষয়ে গবেষক ড. মাহফুজা সুলতানা বলেন,
“নকল পণ্যের মাধ্যমে শুধু ভোক্তার স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে না, বরং রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কাঠামোতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এইসব কারখানার অস্তিত্ব মূলত একটি দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার প্রতিফলন।”
দেশে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংস্থা যেমন বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কিংবা স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় কিছু কারখানা সিলগালা করলেও, বাস্তব চিত্র হচ্ছে—সেইসব কারখানা অল্পদিনের মধ্যেই আবারও কার্যক্রম শুরু করে। সংশ্লিষ্টদের মতে, আইন প্রয়োগে ঘাটতি, মামলা নিষ্পত্তির ধীরগতি এবং সীমিত জনবল এই সমস্যা রোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএসটিআইর এক কর্মকর্তার ভাষ্য,
“আমরা নিয়মিত নজরদারি চালানোর চেষ্টা করি। তবে দেশের প্রতিটি অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করা আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে কঠিন। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া এসব কারখানা চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এ অবস্থার অবসানে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা, আইনি কাঠামোর শক্তিশালী প্রয়োগ এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়। একইসঙ্গে বাড়িওয়ালাদের সচেতন ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যারা অধিক ভাড়ার আশায় তাদের ভবন নকল পণ্যের গুদাম বা উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করছেন।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বলেন,
“এইসব কার্যক্রম শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক ছাপ ফেলতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সমানভাবে সচেতন থাকা জরুরি।”
নকল পরিচ্ছন্নতাপণ্যের ছড়াছড়ি এখন আর ছোটখাটো বিষয় নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই সময় এসেছে সমস্যাটিকে কেবল আইন প্রয়োগ দিয়ে নয়, বরং সম্মিলিত সচেতনতা, নীতিগত সংস্কার ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধানে এগিয়ে আসার।