মোঃ ইমরান সিকদার, তালতলী উপজেলা প্রতিনিধি
বরগুনার তালতলী উপজেলার অংকুজানপাড়া গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও, প্রশান্তির বদলে এসেছে শঙ্কা। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই এই গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ঘন ধোঁয়ার এক অদৃশ্য ছায়া—যা প্রভাব ফেলছে মানুষের স্বাস্থ্যে, জীববৈচিত্র্যে এবং প্রাত্যহিক জীবনে।
৩০৭ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আলো জ্বালালেও, তার প্রতিক্রিয়ায় বিষাক্ত ধোঁয়া ও বর্জ্য পরিবেশকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সালফার ডাই-অক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটারের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধরা চর্মরোগ, হাঁপানি এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, গত দুই মাসে চর্ম ও শ্বাসজনিত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
নূরজাহান বেগম, স্থানীয় এক অভিভাবক, তার শিশুকন্যার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, “বিদ্যুৎ পেলাম ঠিকই, কিন্তু মেয়ে কি সুস্থভাবে বাঁচবে?” বাড়তে থাকা চিকিৎসা ব্যয়, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার অভাবে অনেকেই দিশেহারা।
প্রভাব পড়েছে কৃষি ও মৎস্য খাতেও। নদীতে মাছের উপস্থিতি কমেছে বলে জানান জেলে মনিরুল ইসলাম। তার ভাষায়, “জাল ফেললে ময়লা আর মরা মাছ ছাড়া কিছু উঠছে না।” কৃষকরা বলছেন, বাতাস ও পানির দূষণে ফলন কমেছে, গাছ মারা যাচ্ছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিশেষজ্ঞ মীর মোহাম্মদ আলী জানান, “এই বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে নির্গত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ জলজ পরিবেশের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।” সালফার, অ্যালুমিনিয়াম এবং ভারী ধাতুসমূহ সাগর ও নদীর জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
স্থানীয় পরিবেশ সচেতন সংগঠনের প্রতিনিধি মো. আরিফুর রহমান বলেন, “আমরা বহুবার মানববন্ধন করেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না।” তার মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।
প্রবীণ বাসিন্দা সুলতান সিকদার আক্ষেপ করে বলেন, “বিদ্যুৎ এসেছে, কিন্তু আমাদের জীবন ফিরবে না। এই কি উন্নয়ন?”
উন্নয়ন না জীবনরক্ষা—তালতলীর সামনে কঠিন প্রশ্ন
তালতলীতে আজ এক কঠিন দ্বন্দ্ব—আলোকিত ভবিষ্যৎ, নাকি নিরাপদ জীবন? সরকার যেখানে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে চায়, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ প্রশ্ন তুলছে—এই উন্নয়ন কি মানুষের জীবনের বিনিময়ে?
উপকূলীয় এই জনপদের বাসিন্দারা আজ এককথায় বলছেন, “আমরা আলো চাই, তবে প্রাণের বিনিময়ে নয়।”