রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারণার ভয়ংকর বিস্তার জনজীবনে এক নতুন সংকট তৈরি করেছে। রাস্তাঘাট, মোবাইল ফোন, অনলাইন লেনদেন, এমনকি সামাজিক সহানুভূতির জায়গাও এখন ব্যবহার হচ্ছে প্রতারণার ছকে। প্রতিদিন সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন নানা ছলচাতুরির ফাঁদে পড়ে—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিঃস্ব হচ্ছেন মুহূর্তের ব্যবধানে।
ছদ্মবেশে প্রতারক, মোবাইলে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় পথে বেরিয়ে হঠাৎ পুলিশের পোশাকধারী কাউকে সামনে পেয়ে অনেকেই থমকে দাঁড়ান। অভিযোগ রয়েছে, এমন বেশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতারক চক্র সাধারণ মানুষকে থামিয়ে “নিয়ম লঙ্ঘনের” অজুহাতে জরিমানা আদায়ের চেষ্টা করছে। কেউ আবার “সাইবার নিরাপত্তা” কর্মী পরিচয়ে ফোন করে OTP, পাসওয়ার্ড, বা পিন নম্বর চেয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
চক্রটি আরও একধরনের প্রতারণায় জড়িত—মোবাইলে জানায়, “আপনার বিকাশে ভুলে টাকা এসেছে, ফেরত পাঠান।” ভদ্রতা করতে গিয়ে অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ ফেরত পাঠিয়ে প্রতারণার শিকার হন।
ডিজিটাল ফাঁদ ক্লিকেই সর্বনাশ সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার ধরন আরও বিস্তৃত হয়েছে। কৃত্রিম অফার, ‘পুরস্কার জেতার’ লোভ দেখিয়ে অ্যাপে ক্লিক করাতে বলা হয়। একবার ক্লিক করলেই হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ডিভাইস বা আর্থিক অ্যাকাউন্ট। অনেকে আবার ভুয়া অনলাইন হোটেল বুকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন—অগ্রিম টাকা দেওয়ার পর ফোন নম্বর বন্ধ, ঠিকানা মেলেনি।
পরিসংখ্যানও বলছে ভয়ংকর চিত্র সাইবার অপরাধ দমন ইউনিট সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে প্রতারণা সংক্রান্ত ১,৪২০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭২ শতাংশই মোবাইল বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংখ্যাই বেশি।
পুলিশ বলছে, প্রযুক্তিনির্ভর চক্র শনাক্ত কঠিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, “প্রতারণা চক্রগুলো অনেক সময় দেশের বাইরেও অবস্থান করে। তারা টেলিকম ও অনলাইন অ্যাকসেসের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে টার্গেট নির্ধারণ করে প্রতারণা চালায়। এসব অপরাধ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হলেও গ্রেপ্তার ও শাস্তির প্রক্রিয়া জটিল।”
তবে তিনি জানান, প্রযুক্তি-নির্ভর নজরদারি এবং মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতারণা প্রতিরোধে নতুন কৌশল চালু হয়েছে।
সচেতনতাই এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রতারণার সর্বশেষ ঢেউটি ঠেকাতে হলে জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। তাঁরা বলছেন,
অপরিচিত কেউ OTP, পিন, এনআইডি বা বিকাশ নম্বর চাইলে তা কখনোই দেওয়া যাবে না সরকারি সুযোগ বা পুরস্কারের লোভে ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান বিপজ্জনক।
কোনও লিংকে ক্লিক করার আগে সতর্ক থাকতে হবে প্রতারিত হলেও ভয় না পেয়ে দ্রুত থানায় বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ জানানো জরুরি
প্রতারণা এখন শুধু অপরাধ নয়, এক সামাজিক দুর্যোগ। মানুষ শুধু টাকা হারাচ্ছেন না, হারাচ্ছেন বিশ্বাস, নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতিও। রাস্তায় বেরোনো, ফোন রিসিভ করা কিংবা অনলাইনে লেনদেন—সবই আজ আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতা থেকে পরিত্রাণের জন্য চাই সমন্বিত আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং সর্বোপরি—নাগরিক সচেতনতা।