মোঃ শুকর গাজী, খুলনা প্রতিনিধি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর উপ পুলিশ কমিশনার অপারেশন (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত), এম এম শাকিলুজ্জামান বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং, স্বর্ণ চোরাচালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী,হত্যাকান্ডে জড়িত ও কুখ্যাত আসামীদের গ্রেফতারের জন্য সাঁড়াশী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ জনৈক আসিফ মাহমুদ খালিশপুর থানায় তার মামাতো ভাই তাজকির আহম্মেদ নিখোঁজ হয়েছে এই মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। যার জিডি নং-১১৫৪, তারিখ-২২/০২/২০২৫ খ্রিঃ। এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য খালিশপুর থানা পুলিশের একটি চৌকস তদন্ত টিম প্রস্তুত করা হয়। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে প্রেমিকার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে ভিকটিম তাজকির তার চাচাতো ভাই রনির শ্যালিকা সীমার সাথে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে খুলনা আসেন। তাজকির আহমেদ গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ খালিশপুর থানাধীন গোয়ালখালি এলাকায় তার মামাতো ভাই আসিফ মাহমুদের বাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য আসে এবং বাসাতে কিছু সময় থেকে প্রেমিকা সীমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে নিখোঁজ হন। এই ঘটনায় পরবর্তীতে নিখোঁজ যুবকের পিতা মুরাদ হোসেন বাদী হয়ে এজাহারনামীয় ৫ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরো ২/৩ জন আসামীর বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে খালিশপুর থানার মামলা নং-২২, তারিখ-২৫/০২/২০২৫ খ্রিঃ, ধারা-৩৬৫/৩৪ পেনাল কোড বুজু করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এজাহারনামীয় আসামী ১) সুরাইয়া আক্তার সীমা (২০), পিতা-মোঃ জলিল হাওলাদার, সাং-বাদুরতলী, থানা-মঠবাড়ীয়া, জেলা-পিরোজপুর, এ/পি- বিআইডিসি রোড, নিউজপ্রিন্ট মিলের বিপরীতে, থানা-খালিশপুর, ২) লাবনী বেগম (৪২), স্বামী- মিন্টু মিয়া, সাং-চাপলিয়া পানাইল, থানা-আলফাডাঙ্গা, জেলা-ফরিদপুর, এ/পি সাং-খালিশপুর হাউজিং, থানা-খালিশপুর এবং সন্দিগ্ধ আসামী ৩) শহিদুল ইসলাম সাহিদ (২০), পিতা-মৃত: নজরুল ইসলাম, সাং-হাউজিং এস্টেট, থানা-খালিশপুর, খুলনাদের’কে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করে।
মামলা তদন্তকালে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি খালিশপুর থানা পুলিশ খানজাহানআলী থানাধীন ভৈরব নদীর বালুর মাঠ ঘাটে বস্তা বন্দী একজন অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ পড়ে আছে মর্মে সন্ধান পায়। পুলিশের অনুরোধে জিডির বাদী আসিফ মাহমুদসহ ভিকটিমের পিতা এবং তাদের নিকট আত্মীয়রা খুলনা মেডিকেল হাসপাতাল মর্গে উপস্থিত হয়ে লাশের শরীরে পরিহিত চেক শার্ট ও পরনের প্যান্ট দেখে অজ্ঞাতনামা লাশটি ভিকটিম তাজকির আহম্মেদের বলে সনাক্ত করেন। পুলিশের চৌকস তদন্ত টিম কর্তৃক গ্রেফতারকৃত আসামীদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ, নিরবিচ্ছিন্ন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রযুক্তির সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যে মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়। তদন্তে জানা যায় যে, প্রেমিকা সীমা সম্পর্কে ভিকটিমের ভাইয়ের শ্যালিকা। সীমার এজাহারনামীয় ১ নং আসামী ইসমাইল হোসেন অভির সাথে তিন বছর পূর্বে তাদের পরিবারের অমতে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে অল্পদিনের মধ্যে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায় এবং অভি দেশের বাইরে চলে যায়। এই সুযোগে তাজকির আহম্মেদ এর সাথে সীমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডিভোর্সের ৭/৮ মাস পরে অভি দেশে ফিরে এসে প্রাক্তন স্ত্রী সীমার সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক তৈরি হয়। এসময়ে ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় যা একমাত্র সীমা জানতো। সীমা একই সাথে দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দুই প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক চলমান রাখে যাতে কেউই বিষয়টি বুঝতে না পারে। এদিকে অভি আর সীমার পুনঃ রিলেশনের বিষয়টি তাদের উভয় পরিবারের লোকজন জানলেও ভিকটিম তাজকিরের সাথে প্রেমের বিষয়টি অপ্রকাশ্যে থেকে যায়। কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় অভি সীমার সাথে তাজকিরের প্রেমের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। এটা নিয়ে সীমা এবং অভির মধ্যে ঝগড়া হতে থাকে। অভি ভিকটিম তাজকিরকে শায়েস্তা করার জন্য সীমার ব্যবহৃত গোপন মোবাইল ফোন থেকে হোয়াটস্অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভিকটিমকে খুলনায় আসতে বলে। তাজকির খুলনা আসলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অভি তার বন্ধুদের সহায়তায় তাকে অপহরণ করে নিজ বাসায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অভিসহ ৪ বন্ধু মিলে তাজকিরের হাত-পা বেঁধে মুখে কচটেপ পেচিয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও পুরুষাঙ্গে উপর্যুপরি আঘাত করে, গলায় রশি দিয়ে ফাঁস দিয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে তারা ৪ বন্ধু মিলে ডাকবাংলা থেকে ১০০/- টাকা দিয়ে বস্তা ক্রয় করে তাজকিরের লাশ বস্তায় ভরে ইজিবাইকে করে ভোর রাতে ৪/৫ টার দিকে হার্ডবোর্ড খেয়াঘাটে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পূর্বে ভাড়া করে রাখা ট্রলারযোগে দৌলতপুর যাওয়ার দিকে নদীর মাঝখানে নিয়ে লাশ ফেলে দেয়।
ইতোমধ্যে খালিশপুর থানা পুলিশ আলোচিত তাজকির আহম্মেদ হত্যাকান্ডের ঘটনায় আসামী ১) সুরাইয়া আক্তার সীমা, ২) লাবনী বেগম এবং ৩) শহিদুল ইসলাম সাহিদকে পূর্বে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ এই হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত আসামী ৪) মশিউর রহমান জিতু (২৪), পিতা-মোঃ আনোয়ার হোসেন, সাং-চন্দ্র দিঘলিয়া, থানা-গোপালগঞ্জ, জেলা-গোপালগঞ্জ, এ/পি সাং-হাউজিং বাজার, থানা-খালিশপুর, এবং ৫) রিয়াদ কাজী (২২), পিতা-শহিদুল ইসলাম কাজী, সাং-বিআইডিসি রোড, থানা-খালিশপুর, খুলনাদ্বয়কে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামী জিতু এবং রিয়াদ তাজকির হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। হত্যাকান্ডের পর লাশ বহনের কাজে ব্যবহৃত ইজিবাইকের চালক শহিদুল ইসলাম সাহিদকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। খানার রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আরোও কোন মামলা আছে কী না তা যাচাই করা হচ্ছে। নির্মম এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত অন্যান আসামীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।